বিলুপ্তির পথে শত বছরের রানীগঞ্জ হাট

বিলুপ্তির পথে শত বছরের রানীগঞ্জ হাট

স্টাফ রিপোর্টার:

জামালপুরে শত বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠে রানীগঞ্জ হাট। নদীপথের সহজ যাতায়াত ও শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই রানীগঞ্জ হাট তখন থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ছিল প্রসিদ্ধ। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণে মুখর থাকতো এই হাট। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই সেই প্রাণচাঞ্চল্য। কালক্রমে ঐতিহ্য হারিয়ে এখন কোনোমতে টিকে থাকা এ হাটটি বিলীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

শুরু থেকেই সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার এই দুই দিন বসে হাট। যেহেতু সে সময় নদীপথই ছিল যাতায়াত ও পরিবহনের প্রধান মাধ্যম, তাই নদীকেন্দ্রিক এই হাটে ব্রহ্মপুত্রেই আনা-নেওয়া হতো সব পণ্য। জামালপুর ও তার আশপাশের এলাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগম ঘটত এই হাটে। ধান, পাট, চাল, গম, সরিষা, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের শত শত মণ পণ্যবোঝাই বিশাল নৌকাসহ ব্যবসায়ীদের অন্য নৌযানের বহর ভিড়ত এই হাটের ঘাটে। এসব ছাড়াও আসত বিভিন্ন শস্য, শাকসবজিসহ অন্য পণ্য ও পশুবাহী নৌকা। 

ভূমি জরিপ সিএস সূত্রে জানা গেছে, ১৯১৩ সালে অবিভক্ত ভারতে নাটোরের রানী দেবী চৌধুরানী তার নাম অনুসারে প্রায় ১০ একরজুড়ে এই হাটটি স্থাপন করেছিলেন। 

হাটটি স্থাপনের পর থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত এ হাটটি ছিল এই অঞ্চলের বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তাছাড়া জামালপুর শহরকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার জন্য ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দেওয়ায় নদের গতিপথ বদলে যায়, এরপর থেকে ঘাটে ভিড়তে পারে না কোনো নৌযান, বন্ধ হয়ে যায় দূর-দূরান্ত থেকে পণ্য আনা-নেওয়া। পরবর্তী সময়ে জামালপুর শহর ও শহরের আশপাশে বেশ কিছু বাজার গড়ে ওঠায় আধিপত্য হারাতে থাকে রানীগঞ্জ হাট। রানীগঞ্জ হাটের জমজমাট সেই চিত্র এখন শুধুই অতীত, নেই সেই প্রাণচাঞ্চল্য, নেই ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় ও আশানুরূপ বেচাকেনা। দখল হয়ে গেছে বাজারের আশপাশের অনেক জায়গা। চারদিক থেকে পরিধি ছোট হয়ে এখন অল্প কিছু জায়গায় চলছে হাটের কার্যক্রম। 

হাটে মসলা বিক্রি করতে আসা আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে এই রানীগঞ্জ হাটে ব্যবসা করি, শহরের বিভিন্ন স্থানে আরও কিছু বাজার গড়ে উঠেছে। সে জন্য এখন আগের মতো বিক্রি হয় না। সপ্তাহের প্রতিদিন যদি এই হাট বসার ব্যবস্থা করা হয় ও বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমা-খরচ কম নেওয়া হয় তাহলে ক্রেতা বাড়বে। 

লোহার সামগ্রী বিক্রেতা খাদেম আলী বলেন, ‘৪০ বছর ধরে হাটে লোহার জিনিস বিক্রি করি। আগে অনেক ভালো ব্যবসা করেছি, অনেক লাভবান হতে পারতাম। ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে এখন আর পণ্য নিয়ে নৌকা ভিড়ে না, হাটে ব্যবসা করার মতো পরিবেশ নেই।’

রানীগঞ্জ হাটে নিয়মিত বাজার করতে আসা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘শৈশব থেকেই হাটে আসি, তখন ধান, সরিষা, পাট, মাছ, তরিতরকারি, পান ইত্যাদি অনেক কিছুই বিক্রি হতো। এখন আগের মতো জিনিসপত্র হাটে আসে না। ধান, পাট, সরিষা এসব আর বিক্রি হয় না। খুব অল্প পরিমাণে জিনিসপত্র বেচাকেনা হয়।’

সুলতান আলম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী রানীগঞ্জ বাজারটি দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে। একসময় জমজমাট হাট বসত, মাছের বড় বাজার ছিল, মাংস পাওয়া যেত। এখন অল্প কিছু শাকসবজি, শুঁটকি, দেশীয় কিছু তৈজসপত্র ছাড়া আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না।’

রানীগঞ্জ হাটের ইজারাদার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল এই রানীগঞ্জ হাট। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগে কৃষকরা বিভিন্ন কৃষিপণ্য নিয়ে হাটে আসতেন, এখন আসেন না। হাটে বেচাকেনা কম হওয়ায় হাটটি ইজারা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। প্রশাসন বা পৌর কর্তৃপক্ষ যদি বাজারের উন্নয়নে কাজ করে তাহলে সবার জন্য ভালো হবে। তা না হলে এই ঐতিহ্যবাহী হাটটি হারিয়ে যাবে।’    

জামালপুর পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি পৌর মেয়র হিসেবে ঐতিহ্যবাহী রানীগঞ্জ হাটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। আমি নিজেও দেখেছি পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা আসত। ব্যবসা-বাণিজ্যের ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল এই হাট। নানান কারণে এই হাটটি মৃতপ্রায়।’ 

সূত্র: খবরের কাগজ

জামালপুর ট্রিবিউন/শাকিল আহমেদ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন