স্টাফ রিপোর্টার:
সরিষা ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য পাল্টে দিয়েছে জামালপুর জেলার মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও জামালপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠের দৃশ্যপট।
শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো হলুদ সরিষা ফুলের সমারোহে মুগ্ধ হয়ে উঠছে চারদিক।
উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ফুলের মিষ্টি গন্ধে মাতাল হয়ে চারদিকে গুন গুন শব্দে গান গেয়ে মধু আহরণে ব্যস্ত মৌমাছিরা।
গ্রাম বাংলার বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠে মনমুগ্ধকর এ চিত্র দেখে যে কোন পথচারী মৌ মৌ গন্ধে ক্ষণিকের জন্য হলেও মনের অজান্তে থমকে দাঁড়ায় ফুলের সুবাসে। এমন দৃশ্য কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। কোন রোগবালাই না থাকায় সরিষার ভালো ফলন নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকেরা।
জামালপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জামালপুরের ৭ উপজেলায় ৪৬ হাজার ২৭৮ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরিষা চাষ হয়েছে ৪১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও গত বছরের চেয়ে সরিষার চাষ বেশি হয়েছে। গত বছর ৪১ হাজার ১২৬ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে।
একাধিক কৃষকের সাথে জানা গেছে, সপ্তাহকাল ধরে সরিষা ফুল ফুটতে শুরু করেছে। আরও অন্তত এক মাস ফুল থাকবে। দুই মাসের মধ্যেই সরিষা তোলা যায়। গত বছরের সরিষার দাম ভালো ছিল। মনে হচ্ছে এ বছরেও দাম ভালোই হবে।
জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীরচরের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি ৫ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। আবহাওয়া ভালা থাকলে ফসল ঘরে তুলতে পারবো।
তিনি আরও জানান, দেশীয় সরিষার জাতগুলোর চেয়ে উন্নত জাতগুলো ফলন বেশি হয়। গত বছরের চেয়ে সরিষা আবাদ ভালো হয়েছে। আশা করি লাভও ভালোই পাওয়া যাবো।
সরেজমিনে সদর উপজেলার কেন্দুয়া কালিবাড়ীর সরিষাবাড়ী-জামালপুর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে শ শ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। সকালে সোনালী রোদে চিকচিক করছে সরিষা ফুল। সড়কের পাশে মধু আহরণের জন্য মৌয়ালরা মৌমাছির বক্স সারি সারিভাবে সাজিয়ে রেখেছে মধু সংগ্রহ করতে। ছোট্ট একটি ছিদ্র দিয়ে বক্স থেকে অনবরত মৌমাছি চলাচল করছে।
মহুয়াডাঙা গ্রামের কৃষক খোকন মিয়া বলেন, সরিষা চাষে খরচ অনেক কম কিন্তু লাভটা বেশি হওয়ায় অনেকেই সরিষা চাষে আগ্রহী। ক্ষেতে একবার সার প্রয়োগ করলে আর সার দিতে করতে হয় না, তাই অন্য ফসল থেকে পরিশ্রম ও সময় কম দিতে হয় সরিষা চাষে । তিনি আরও বলেন, সরিষাসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকলে এখানকার কৃষকরা আরও বেশি উপকৃত হতো।
সরিষাবাড়ীর কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, সরিষা আবাদে খরচ অনেক কম, কিন্তু দাম যদি একটু হয়, তাহলে আমাদের একটু ভালো হবে। অন্যান্য ফসলের থেকে এ ফসলের পরিশ্রমও কম।
ইসলামপুরের কৃষক আব্বাস আলী বলেন, বেড়ে ওঠা গাছ আর ফুল দেখে বেশি ফলনের স্বপ্ন দেখছেন উপজেলার কৃষকেরা। গত বছর স্থানীয় বাজারে উন্নত জাতের সরিষার দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকেরা এবারও সরিষা চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর প্রত্যেক চাষি বেশি মুনাফা লাভ করবে।
মেলান্দহ উপজেলার টুপকারচর এলাকার কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষে খরচ হয় এক-দেড় হাজার টাকা। ফলন পাওয়া যায় পাঁচ-সাত মণ। প্রতি মণ সরিষার বাজারমূল্য দুই হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
হাজারবাড়ী এলাকার দাঁতভাঙা সেতুর পাশে সরিষাক্ষেতে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী রোমান আহমেদ বলেন, এবার সরিষাক্ষেত খুবই ভালো হয়েছে। অনেকেই এখানে ঘুরতে আসে। আমিও ঘুরতে এসেছি, ছবি তুলে চলে যাব।
মেলান্দহ উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, আমন ছাড়াও জমি থেকে সরিষা ওঠার পর ওই জমিতে প্রচুর বোরোর আবাদ করা যায়। এতে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় ও বোরোর ফলন ভালো হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পরিমাণ সরিষার চাষ হয়েছে। এবছর সরিষার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ হাজার ১২০ হেক্টর। অর্জিত হয়েছে ৭ হাজার ১০০ হেক্টর। কৃষকেরা অধিকাংশ জমিতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বারি-১৪, বারি-৯, বিনা-৯/১০, সরিষা-১৫, সোনালি সরিষা (এসএস-৭৫) ও স্থানীয় টরি-৭ আবাদ করে।
মেলান্দহ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল জানান, এবারে মেলান্দহ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে বিগত বছরের তুলনায় বেশি সরিষা চাষ হয়েছে। যথা সময়ে জমি চাষ যোগ্য হওয়ায় এলাকার কৃষকেরা সুযোগ বুঝে সরিষা চাষ করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোন প্রকার ক্ষতি না হলে এবছর সরিষা আবাদের বাম্পার ফলনের সম্ভবনা রয়েছে। শুধু তাই নয় সরিষা চাষের জমিগুলো উর্ব্বরতা বেশি থাকায় কৃষকেরা বোরো চাষেও এর সুফল পাবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা এ প্রতিবেদককে বলেন, গত বছরের থেকে এবার সরিষার চাষ বেশি হয়েছে। আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম, তা অর্জিত হয়নি। কৃষকেরা দিন দিন ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। আমরা আশা করছি, এ বছর সরিষার ভালো ফলন হবে। এতে কৃষকরাও লাভবান হবে এবং পরবর্তী বছরে আরও বেশি জমিতে সরিষা চাষ করা হবে।
জামালপুর ট্রিবিউন/
0 মন্তব্যসমূহ